নিষ্প্রভ এক গোধূলিবেলায়.........

-ভাইয়া......আজ না আসলে হয়না? 
-দয়া করে আসো । 
-উহু,ঘুমাইনি ২ দিন। 
-বই নিয়ে আসবো 
-কার? 
-হুমায়ুন আজাদের । 
-আর? 
-আর কিছু পিডিএফ । 
-আচ্ছা । 
-কখন? 
-যখন সময় হবে । 
-আসবে তো? 
-হু । 

অনিরুদ্ধ শস্তি বোধ করে।১৭/১৮ দিন পর তবে রাজি হলো মেয়েটা! নিরামেষী মেয়ে একটা!সচরাচর এমন মেয়ে সে দেখেনি।অদ্ভুতুরে একদম।মেয়ে না যেন সাক্ষাৎ মা কালী।প্রিয় মানুষ গুলোকে অনিরুদ্ধ খুব ভয় পায়।তবে সবচাইতে বেশী ভয় পায় তন্দ্রাকে।মেয়েটার তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই।বিশালাকার ঢিলে ঢালা জামা পড়ে
,চোঁখে হালকা কাজল লাগায়,আধুনিকতার বালাই নেই!ঠোঁটেও কিছু লাগায় না।হাতে,কানে,গলায় কিছু পড়েনা।ওড়না সচেতন,বেশ গোছালো তবুও,সব কিছুই ঠিকঠাক ছিলো,যদিনা ওমন সাধারণ একটা মেয়ের কোমর অবধি চুল,পাতলা গোলাপী ঠোঁট,মায়াবী একজোড়া চোঁখ,আর চিবুকের ডান পাশে কালো তিলটা না থাকতো।কথায় দর্শনে মেয়েটাকে বিশ্লেষণ করা একবার খুব সোজা হয়ে যায়,একবার খুব কঠিন,নিজের চারপাশে বিভ্রান্তির জাল ছড়িয়ে ভেতরে সেই মেয়ে দিব্যি বসে থাকে।অনিরুদ্ধ তার দর্শনের প্রেমে পড়ে যায়,আর যখন প্রথম তাকে দেখেছিলো ঐ যে চারটি জিনিস ঐ চার জিনিস ই এই সাধারণ মেয়েকে অসাধারণ করে দেয়।তন্দ্রা খেয়াল করেছিলো অনিরুদ্ধ কেমন হা করে তার বৃষ্টির পানি নিয়ে খেলা দেখছিলো।এতো মেয়ে থকতে এই পাগলাটে মেয়েটাকেই তার মনে ধরলো। 

-আপনি কোথায়? 
-আসো তুমি । 
-দুঃখিত,দেরি করে ফেলেছি । 
-ধুর,আসোতো 

সাদা পাঞ্জাবী পড়ে এসেছে,তন্দ্রা খুশি হয়,হাসতে গিয়েও হাসে না । 

-পাঞ্জাবী! 
-হুম,তুমি পছন্দ করো তাই । 
-অদ্ভুত একটা পাঞ্জাবী,কিন্তু সুন্দর ! 
-এই নাও পেনড্রাইভ 
-কী আছে? 
-বই ,আর কিছু মুভি 
-এটা আপনার । 

রিক্সা ভ্রমণ।দুজনেই প্রায় তালপাতার সেপাই।তন্দ্রা তবু গজ গজ করে। 

-রিক্সা ছোট? নাকি আমরা মোটা? 
-স্যুরি 
-স্যুরি না,স্যরি 
-আচ্ছা,স্যরি 
-সিগারেট খান না? 
-তোমার ভয়ে কীভাবে খাই! 
-খেয়ে এসেছেন? 
-জ্বী জনাবা । 
-ভালো 
-তুমি? 
-জানেন ই তো । 
-তুমি বড্ড অগোছালো । 
তন্দ্রা খায় না ,মনে চাইলে খায়,নয়তো খায়না,কেউ জোর করেও খাওয়াতে পারেনা। 
-এই রিক্সা থামাও । 
-এতো সহজে মানুষ কে তুমি কীভাবে বলেন? 
-সহজ,চেষ্টা করো । 
-দরকার নেই 

দুজনে হাঁটতে শুরু করে।তৃতীয় দেখাতে অনিরুদ্ধ তন্দ্রার হাতের স্পর্শ পেয়েছিলো,সে এক অলৌকিক কাহিনী, ও প্রসঙ্গে না যাই……… 
-এভাবে হাঁটেন কেনো? 
-স্যরি 
-হু হয়েছে,আমি এদিকে হাঁটবো 
-আচ্ছা 
-দূরে যান (অসহ্য) 
তন্দ্রা রাস্তার গাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটে ,পাশ দিয়ে একটা গাড়ি যখন দ্রুত বেগে চলে যায় চুল উড়িয়ে সে খুব মজা পায়।ল্যাম্পপোস্ট গুলো ভীষণ পছন্দ তার।অপলক তাকিয়ে থাকে,এই একটা দুর্বলতা তার । 
-চলো কোথাও বসি 
-লাগবেনা 
-এভাবে হাঁটতেই থাকবে? 
-সমস্যা? 
-নাহ 
-এই ল্যাম্পপোস্ট গুলো সুন্দর না । 
-কেনো? 
-নতুন এগুলো।বলা যায় ডিজিটাল ।সোডিয়ামের গুলো সুন্দর। 
-তন্দ্রা! 
-কী? 
-হাতটা দেয়া যায়? 
-হু 

চুপচাপ হাঁটতে থাকে দুজনে ।পেছনে অনেক ল্যাম্পপোস্ট আর অজস্র হতাশা কষ্ট ফেলে। 

-এখানে বসি? 
-আচ্ছা 
-ঐ মেয়েটাকে দেখছেন? 
-কেনো? 
-হিহিহি 
-বাদ দাও তো 
-আমিও তো তাদের মতো হতে পারি,সমস্যা কী?টপস আর জিন্স,হিহিহি 
-ভালো লাগবেনা,হুহ! 
-আমি পোষাকী স্বাধীনতায় না,আত্মার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।Dress doesn’t matter. 
-হাতটা? 
-এইযে 
_এতো লম্বা আঙ্গুল! 
-সবই কলা গাছ 
-মোটেও না 
-মোটেই হ্যাঁ 
-জায়গাটা সুন্দর না? 
-হুম,চলো কোথাও খেতে যাই।ক্ষুধা লেগেছে 
-উত্তর টা আপনি জানেন । 
-আচ্ছা 
-তুমি করে বলা যায়? 
-না 
-প্রাকটিস? 
-তাও না 
-কোনো দিন হবে? 
-না 
-কেনো? 
-চুপ,কোনো প্রশ্ন না । 

তন্দ্রা এই প্রথম মনোযোগ দেয় হাতটাতে।তার হাতটা অন্য একজনের হাতে।হাতটা অনুভব করতে যায়, পারেনা।সব অনুভূতি কেমন যেন ভোতা হয়ে গিয়েছে তার।তার সর্বদা মনে হয় এই হাতে লেগে আছে অন্য কারো স্পর্শ।অন্য কারো ছিলো যে।অন্য একটা অবয়ব।একটা ছেলে।হালকা স্পষ্ট মুখ।তন্দ্রা আর ভাবতে পারেনা,অনিরুদ্ধ ডাক দেয়……… 

-এই তন্দ্রা 
-জ্বী? 
-না কিছুনা 
-বলেন 
-ভালোবাসি 
-ধন্যবাদ 
-কিছু কী খাওয়া যায় না? 
-না 
-ঝাল-মুড়ি? 
-না 
-আইসক্রিম? 
-উহু 
-ফুচকা? 
-না 
-পানি তো খাও?কতক্ষণ ধরে আছি এখানে,পিপাসা তো লেগেছে! 
-না 
-অদ্ভুত! 
-হু 
-একদিন বাসায় সব ‘না’ রেখে আসবে 
-পারবো না 
-ভয় পাই 
-চলেন,উঠি 
-এখনই!!! 
-হু 

উঠে যায় দুজনে।অনিরুদ্ধ পানি কিনে নিয়ে আসে।তন্দ্রা সেই পানির বোতলটা ছুঁয়েও দেখেনা।আবার হাত ধরে অনিরুদ্ধ ।চুপচাপ থাকে দুজন।তাদের ভেতর চলতে থাকে হাজার বছরের জমানো কথা,নীরবেই।অনিরুদ্ধ তার খোলা চুল গুলো দেখে,মনে মনে প্রার্থনা করে চুল গুলো এসে যদি তার মুখ ঢেকে দিতো!তা হয়না,তন্দ্রা সতর্ক থাকে। 

-আজিব! 
-ক…কী? 
-দূরে যান তো 
-স্যরি 
-পাশাপাশি আধান যুক্ত দুটো বস্তু রাখলে কী হয় জানেন? 
-হু…উহু…। 
-ইলেকট্রন আদান প্রদান!আমার ইলেকট্রন চলে যাবে… 
-স্যরি তো! 
-হু 
-তোমাকে একটা গালি অভিধান বই দেবো 
-আচ্ছা 

দুজনে বাসার কাছে চলে আসে,তন্দ্রা কথা বলেনা।মৃদু বাতাসে তার ওড়না উড়ে যেতে চায়,সে সতর্ক থাকে,অস্ফুট স্বরে বলে “উশৃঙ্খল বাতাস”।অনিরুদ্ধ মেয়েটার চোঁখ দেখে,মায়াবী চোঁখ।চোঁখ সরাতে পারেনা।পরক্ষণেই ভয়ে সরিয়ে নেয়।হতাশা ফিরে আসতে থাকে………… 

সে এমন এক সাধারণের প্রেমে পড়েছে, 
যাকে ধরা যায়, 
ছোঁয়া যায়, 
অনুভব ও করা যায়, 
তবু বিশ্লেষণ করা যায়না! 

তন্দ্রা কোনো দিন রিক্সা থেকে নেমে বিদায় বলেনা । 
অনিরুদ্ধ নিষ্প্রাণ চোঁখে তাকিয়ে থাকে, 
না পাওয়া স্বপ্নের দিকে, 
অনিশ্চিত ভালো লাগার দিকে, 
সে হেঁটে যায়…। 
এক সময় তার ছায়াও মিলিয়ে যায় । 
গলির শেষ দিকের মাথায় তার ছায়াটাও হারিয়ে গিয়েছে… 
একবুক হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে যায় অনিরুদ্ধ……… 
ইলেকট্রনের মতো হতাশাও যদি দান করা যেতো!!!!! 

Comments