শেষ পরিণতি

বড় অদ্ভুত ছেলেটা।মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।কোঁকড়ানো আর জট পাকানো চুলই বলে দেয় যে বহুদিন পানির সংস্পশে আসেনি।নিয়মিত যে ঘুম হয় না টা চোখের নিচের কালো দাগ দেখেই বোঝা যায়।মোটা হুলদ ফ্রেমের চশমার পেছনে থাকা চোখ জোড়া সারাক্ষণ কাকে যেনো খুঁজে ফিরে।
ছেলেটাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম বাংলা স্যারের ব্যাচে।আর দশটা ছেলে থেকে আলাদা হওয়াতেই হয়তো ও এইভাবে আমার চোখে পড়লো।সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ছেলেটা কারো সাথে কথা বলে না আর কেউ ওর সাথে কথা বলতেও চায় না।কেউ তার নাম পর্যন্ত জানে না।তাই আমি ওর নাম দিয়েছি কবি।ওর জট পাকানো চুল আর প্রতিদিন পরে আসা নীল পাঞ্জাবিটা দেখে সবাই ভাবে ছেলেটা হয়তো খুব বেশি খ্যাত।আমি কবিকে যতদিন দেখেছি ততদিন এই নীল পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় দেখেছি।যে ছেলেটার হাতের ঘড়ি,পায়ের জুতা ব্র্যান্ডের তার প্রতিদিন পরে আসা নীল রঙের পাঞ্জাবিটা তাই আমাকে খুব বেশি ভাবাতো।
আমি অনেকদিন চেয়েছি ছেলেটার সাথে কথা বলতে কিন্তু ও ব্যাচ শুরুর ঠিক পাঁচ মিনিট আগে আসে আর ব্যাচ শেষ হওয়ার পর কই যে উদাও হয়ে যায় তা কেউ বলতে পারে না।
বেশ কিছুদিন আগে স্যার আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সামনের সাপ্তাহে স্যার দেশের বাইরে যাওয়ার কারনে পড়াতে পারবেন না।তারপরও আমি ওই দিন স্যারের ব্যাচে যাই কারন আমি জানতাম স্যার পড়াবে না, এই খবরটা কবি জানে না তাই ও ঠিকই পড়তে আসবে।
ছেলেটা স্যারের ব্যাচে ঢুকতে যাবে এমন সময় আমি পিছন থেকে প্রশ্ন করলাম,"এই ছেলে তোমার সমস্যা কি??"
ছেলেটা অনুসিন্ধৎসু চোখে ভ্যাবাচেকার ভাব নিয়ে বাইরের ঝুম বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি আবার প্রশ্ন করলাম,"কাকে খুঁজছো??ওভাবে বাইরে তাকিয়ে আছো কেন?"
ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,"বৃষ্টিতে ভিজবেন??"
ছেলেটা আমার হ্যাঁ বা না এর জন্য অপেক্ষা না করেই বৃষ্টিতে ভিজতে চলে গেলো,সাথে আমিও গেলাম।ছেলেটা বলতে শুরু করলো,"আমি পূর্ণতাকে এই ব্যাচে পড়তে এসেই প্রথম দেখেছিলাম।ওকে দেখলেই আমার মাঝে অদ্ভুত এক অনুভূতি ভর করতো।মনে হলো অনেক আগে বোনা বীজ ফুঁড়ে যেনো সদ্য চারা গাছ জন্মাল।ওর চোখের অদ্ভুত মায়া আমকে পাগল করতো আর আমি বিভোর দৃষ্টিতে ওর চোখের মায়াজালে হারিয়ে যেতাম।তারপর একসঙ্গে বহুদূর চলা।ও আমার হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিলো একসঙ্গে চলার।আমিও দিয়েছিলাম।
আমাকে পাঞ্জাবি পরা দেখলেই ও বলত আয়ান তুমি কি জানো তোমাকে পাঞ্জাবি পরলে কতো সুন্দর লাগে??আমার তখন মনে হয় বার বার তোমার প্রেমে পড়ি।ও চাইতো আমি ওর সাথে দেখা করার সময় যাতে সব সময় পাঞ্জাবি পড়ে আসি।কিন্তু আমি পড়তে চাইতাম না।এই নীল পাঞ্জাবিটা আমার জন্মদিনে পরার জন্য কিনে দিয়েছিলো পাগলীটা।
আমার জন্মদিলের ঠিক দুইদিন আগে ফোন দিয়ে বলল,"আয়ান আমি তোমাকে নীল পাঞ্জাবিটা পরা অবস্থায় আজকেই দেখতে চাই।আমার পক্ষে দুইদিন অপেক্ষা করা সম্ভব না।তুমি আজকে স্যারের ব্যাচে আসার সময় পাঞ্জাবিটা পরে আসবে।"
আমি পাঞ্জাবিটা পরে যখন ব্যাচে ওর অপেক্ষার প্রহর গুনছি,রোড অ্যাক্সিডেন ওর লাশটা তখন ঢাকা মেডিকেল মর্গে পড়ে ছিল।খবর পেয়ে ছুটে গেলাম ওর কাছে।চুপচাপ আমার পাগলীটা শুয়ে আছে।কাছে গিয়ে বললাম দেখো,তোমার আয়ান তোমার দেয়া পাঞ্জাবিটা পড়েছে।একটিবার চোখ দুটো মেলো।আমি কথা দিচ্ছি এরপর থেকে আমি সবসময় তোমার সাথে দেখা করার সময় পাঞ্জাবি পড়ে আসবো।
সেই থেকে আমি এই পাঞ্জাবিটা পড়ে থাকি।বলা তো যায় না পাগলীটা এসে যদি আমাকে এই পাঞ্জাবি পড়া না দেখে আবার রাগ করে।এমনিতেই আমার পাগলীটা অনেক অভিমানি।"
ছেলেটা থামল এই বলে।হটাৎ কালো রঙের একটা গাড়ি এসে আমাদের সামনে থামল।ড্রাইভার গাড়ি থেকে ছাতা নিয়ে বের হয়ে বলতে লাগলো,"ভাইজান আপনে আবার বৃষ্টিতে ভিজছেন??আম্মাজান দ্যাখলে আমারে খুব বকবো।আপনেরে লইয়া আমার হইসে যতো জ্বালা।উঠেন তো গাড়িতে তাড়াতাড়ি"।ছেলেটা কিছু না বলেই গাড়িতে উঠে গেলো।
গাড়িটা আস্তে আস্তে আমার দৃষ্টি সীমা থেকে পার হয়ে গেলো।আমি তবুও দাঁড়িয়ে রইলাম।আমি কার অপেক্ষায় বা কিসের আশায় দাঁড়িয়ে আছি তা জানি না।কিন্তু এটা জানি আয়ান তার পূর্ণতার অপেক্ষায় থাকবে,আর পূর্ণতা বেঁচে থাকবে এই ভাবেই আয়ানের মাঝে।পৃথিবীর সুন্দরতম প্রেমের গল্পগুলো বুঝি এমনই,শুরুর আগেই শেষ হয়ে যায়।যে প্রেমের গল্প যতো বেশি মধুর,তার শেষ পরিণতি ততো বেশি করুণ।

Comments