প্রতিশোধের দিন

আমি বরাবর ই দুর্বল মস্তিষ্কের মানুষ।এই মস্তিষ্ক যা অপ্রয়োজনীয় মনে করে মনের কোনাতেও তাদের সীমিত পরিসরের ঠাই হয়না।বড্ড দুর্বল মস্তিষ্ক বলেই তোমাদের সেই মে মাসের ৯ তারিখের উচ্ছ্বাস গুলোর কথা আমার মনে নেই।ভুলে ,পানির সাথে গুলে,খেয়ে বসে আছি।মনে নেই তোমাদের মধ্যমা আর তর্জনী আঙুলের সেই বিজয় চিহ্ন আমি দেখাতে পারিনি,একদম পারিনি,এক বারের জন্যও পারিনি।লক্ষ্যের খুব কাছ থেকে কেউ আমার পেছন থেকে বলে দিয়েছিলো “তুমি ব্যর্থ,ফিরে যাও”।
সে কথা ভুলে গিয়েছি,অকপটে!
আমি অভিমানী মানুষ।স্কুল লাইফের তোমাদের প্রেমের
হিড়িক দেখে প্রেম করবার শখ জেগেছিলো।ভীষণ......প্রেম আমার জীবনে দেরিতে এসেছিলো তবুও ......করেছিলাম।।তার বিনিময়ে যে জীবনের মানেটাই বদলে যাবে সে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।জীবন স্বর্গ না হয়ে নরক হয়ে গেলো,পরিবার মমতাময়ী না হয়ে অত্যাচারী হয়ে গেলো,বন্ধুরা মাথা গুঁজবার ঠাই না হয়ে শত্রু হয়ে গেলো,কিছু ধিক্কার দিয়ে চলে গেলো। আমি অভিমানী যে,তোমাদের না জ্বালিয়ে সরে এলাম,একা করে ফেললাম নিজেকে।কালের বিবর্তনে সময়ের পরিক্রমায় সেই তাকেও ছেড়ে এলাম।কতোজন এলো,কতো গেলো,কোথাও সে ছিলোনা,তাকে আর খুঁজিওনি।
ভুলে গিয়েছি,স্বইচ্ছায়!
বড্ড ভুলোমনা আমি।স্মৃতির ঘরে নিঃশব্দে অনেক কিছু জমিয়ে তালা বদ্ধ করে দেই।যাতে সময়ে অসময়য়ে আমায় বিরক্ত না করে।সবার মতো মার্কসিট আমার স্বর্ণালী ছিলো না।কোথাও খাদ ছিলো,কিছু একটার অনুপস্থিতি ছিলো,একটা যোগ চিহ্নের অনুপস্থিতি।একটা যোগ চিহ্নের বড় অভাব তখন।তখন চারদিকে সংবর্ধনা,কৃতীদের।আমিও ছিলাম,ক্যামব্রিয়ান কিংবা নন্দনের দিনে।আমার শরীরটা উপস্থিত ছিলো,মনটাই ছিলো না,আত্মার মৃত্যু সেই কবেই হয়েছিলো।কেউ টের পায়নি।সেদিন নন্দনের রেজিস্ট্রেশন।ফর্ম যিনি জমা নিচ্ছিলেন যখন জিজ্ঞাসা করছিলেন ,”মনিপুর থেকে সবার গোল্ডেন আপনি একাই এ প্লাস!?” আমি কেবল হ্যাঁ বলেছিলাম বহু কষ্টে চোখের জল আমি আটকে রাখতে জানি।
জন্মগত প্রতিভা।
সেদিন মনে হয়েছিলো রসায়ন আমায় সারাজীবন মনে করিয়ে দেবে,তার পাশে একটি প্লাস নেই,সে একটি শুধু মাত্র “এ”।আর এই যোগ চিহ্ন একদিন হবে বিভিষীকা,সে ভাবনাও ভুলে গিয়েছি......
ফার্মগেটের রাস্তায় আমার নিত্য আসা যাওয়া।গোল ফ্রকের সাদা ড্রেস পড়া মেয়েদের দিকে বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।এখানে পড়ার স্বপ্ন টা তখন টোকা দিতো স্মৃতির আকাশে।ওদের পূজো করতে ইচ্ছে হতো। ওরা হলো তারা ,যারা পিতামাতার বুকটাকে আরেকটু উঁচু করে নিজের নামটা লিখে রেখেছে।আমি পড়ি এক হোমরাচোমড়া কলেজে।যেখানে টেস্টের আগেই আমার বাপের লাখ খানেক টাকা পানির দড়ে নামিয়ে নিয়েছে। নিতান্ত অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাই! কোথায় তাঁদের কিছু দেবার কথা উল্টে নিয়েই যাচ্ছি!আমার আম্মা...খুব ধার্মিক মানুষ।সারারাত প্যাঁচার মতো জেগে থেকে সকালে দরজা খুলে বের হতেই আম্মাকে দেখি,জায়নামাজে বসে কাঁদছে,নিত্য দিনের ঘটনার মতোই উড়িয়ে দেই সেই অশ্রু সিক্ত চোখ।
অতঃপর সেই দৃশ্য মনে থাকেনা।ভুলে যাই।মানুষ সদাই দুর্বলতা এড়িয়ে যায় যে !
প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল অবধি ঘুমাই।সারাদিনে এইটুকুই আমার ঘুমের সময়।সর্বসাকুল্যে ৪/৫ ঘন্টা।এর বেশী হয়না।পারিও না।বিকেলে শিক্ষক পড়াতে আসে।বুয়েটিয়ান।ভাইয়া পাশের ইউনিটে থাকে।সেইদিনের কথা আমার মনে আছে,ভাইয়ার বুয়েটে চান্স পাওয়া,আমাদের ফ্ল্যাটের দোতলা জুড়ে সেদিন যেন উৎসব ছিলো!ভাইয়ার মায়ের হাঁসিটা কতোটা প্রাণবন্ত ,উচ্ছল,গর্বিত আর পরিপূর্ণ ছিলো সে বুঝেছিলাম।তেমন একটা হাঁসি কতদিন আমার নিজের মা টা হাসেনা!সে খেয়াল আমি কমই রাখি।প্রতিদিন যুক্তির জোরে ভাইয়া ,”বলদ”, “গাধা”, “গরু” বলে যায়।নিজের দোষেই নিজের সময় হেলায় হারিয়ে বসে আছি।নির্লজ্জের মতো মাথা নিঁচু করে হাঁসি দেই।
সে হাঁসি ভেতরকার ব্যর্থতার উপর ব্যর্থ প্রলেপ লাগাতেও ব্যর্থ হয়ে যায়।
এরপর আবার রাত আসে।অসহ্য রাত।নিঃশ্তব্দ কালো রাত।একরাশ হতাশা সহাস্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার উপর।তাদের ভর আমার ভেতরের সব অনুভূতিকে মুহূর্তে আড়াল করে দেয়।স্বপ্নরা মরে যায়।স্মৃতিরা ধূসর হয়।অশ্রু কণা মুখেই শুকায়।বালিশ ভেজে।সেই সাথে সৃষ্টি হয় কিছু অখাদ্য কবিতা কিংবা বেনামী গল্প।সময়ের সাথে সেগুলো ফেসবুকে আসে বাহবা হয় নিন্দাও হয়।সেগুলো ও মনে থাকেনা। মনে রাখিনা।
নিন্দা গুলো স্বআনন্দে বুকে নিয়ে আবার লিখে যাই......
তবু আমি ভুলে যাই সব কিছু ভুলতে নেই।সমস্ত জীবন আমি হতাশাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকতে পারবো না।চাইলেও মৃত্যুকে বরণ করতে পারবো না। রঙিন দুনিয়ায়,কৃতীদের দুনিয়ায় জায়গা ছাড়া জগতে কেউ কারো কথা শোনেনা,কারো মূল্যায়ন হয়না,মূল্যায়নের জন্য পায়ের নিঁচে শক্ত মাটি দরকার হয়,সুদৃঢ় ভিত লাগে,নিজের পরিচয় লাগে,কাগজ কলমে গোটা হরফের যোগ্যতা লাগে,মানিব্যাগের স্বাস্থ্য ভালো হতে হয়,বাপের অঢেল পয়সা থাকতেহয়,আর। তা না থাকলে যা লাগে তাকে কেউ রূপার চামচ বলে ,কেউ অধ্যাবস্যায় বলে আর কেউ বলে মেধা।
এখন ঐ মস্তিষ্কই অনেক কিছু মনে করতে পারে।সকল দৃশ্য প্রতিদিন স্লাইড শোয়ের মতো ভেসে বেড়ায়,হাজার ফেলের গার্ডিয়ান মিটিং,হাজার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য,ব্যঙ্গ,হাজার নিন্দা,হাজারো দুয়ো,সহস্র অপমান।না সে ভুলে নি,সে মনে রেখেছে,মনে রেখেছে তোমাদের সব কিছুকে,স্বযত্নে।দাবার শেষ চাল অবধি খেলা টিকে থাকে,তোমাদের চোখে আমি অবশ্য পরাজিত,কয়লা হওয়া জীবাশ্ম গাছ।তবু তোমাদের অজান্তেই সেই গাছের ছোট্ট বীজ নিজেরাই মাটিতে ফেলে গিয়েছো! সে অবশ্য উদ্দীপ্ত এক কণা,পাথরের পেছনে সুপ্ত আশ্রয়ে একটু একটু করে সে বড় হতে থাকে,সূর্য আর ঝড়ো হাওয়া তাকে শেষ করবার ইচ্ছেতে তেজ বাড়ায়,ঝলসে দিতে চায়,ছোট্ট কণা তবু উদ্ভাসিত হয় ,সকল বিঘ্ন পেড়িয়ে।সে তো এক সূর্যমুখী কণা।সূর্যের তেজস্বীতাকে টেক্কা দিয়ে জগতের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
স্বমহীমায়।
হ্যাঁ! আমি বাঁচবো সুর্যমূখীর মতো। আমি বেড়ে উঠবো,কেউ বসে নেই নতজানু হয়ে।
এখানে পাল্টে যাওয়াই বেঁচে থাকা।
আসবে একদিন আমারো আসবে।অবশ্যই আসবে।সেদিন জবাব দেবো আমি।অনেক কথার,অনেক উপেক্ষার,অনেক ঐদ্ধত্যের।সব কিছু দিয়ে দেবো,তবু সেইদিন আমি দেখে ছাড়বো।
আমার স্বপ্নের অনেক দাম ছিলো। তার প্রমাণ আমি দিয়ে যাবো।তোমাদের উপহার হিসেবে দিনটাকে উৎসর্গ করে যাবো আমি।
সেইদিন হবে কেবল আমার দিন।
আমার প্রতিশোধের দিন।
আমার স্বপ্নের দিন।
সেদিন কেবল আমি জিতবো,তোমরা পরাজিত হবে।
দেখে নিও......

Comments