অভ্যেস বলে কিছু হয়না এ পৃথিবীতে, পাল্টে যাওয়াই বেঁচে থাকা (গল্প)

১।
.........
অনবরত হাটতে হাটতে অর্ণা প্রায় ক্লান্ত।অক্লান্ত চোখ গুলো সোডিয়ামের নয়নাভিরাম আলো গোগ্রাসে গিলছে কিন্তু একটু পর পর পেটের ভেতরের মোচর গুলো জানান দিচ্ছে সে খুব ক্ষুধার্ত।নিজেকে কিছুটা শান্ত করে রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের নিচেই অর্ণা বসে পড়ে।চারপাশ দিয়ে হঠাৎ করে দু একটা ছেলে যাচ্ছে,অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে,কিছু দূর সামনে যাবার পরে বলছে “আরে ভাড়ায় যাবে মনে হয়............হা হা হা” ।অর্ণা কথা গুলো তোয়াক্কা করেনা।ফোনের বাতিটা জ্বলছে
আর নিভছে,ক্লান্ত লাগছে,মনে হচ্ছে জগত টা ঘুরছে।অসারতা পেয়ে বসেছে, পা দুটো নাড়ানো যাচ্ছে না।অবুঝের মতো দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে।ফোনের স্ক্রিনটাও ঝাপসা লাগছে এখন,খুব অসহায় ভাবে আকাশের দিকে তাকায় অর্ণা,একটা মৃতপ্রায় চাঁদ হাসছে, যেন অবজ্ঞা করছে তাকে!

একটা নাম্বার থেকে প্রায় ১০/১২ বার ফোন এসেছে,আরেকটা নম্বর থেকে দুটো টেক্সট,......অর্না ফেসবুকে ঢুকে। একটা অপরিচিত আপুর উদ্বিগ্নতা তাকে হালকা নাড়ায়,বাহুল্যতা বলে যে কিছু আছে সে ভুলে যায়।সব কিছু যেন খুব সহজ স্বাভাবিক।পৃথিবীর কোথাও কিছু বদলায় নি। অর্ণা কী মনে করে ফোনটা ধরে.........
-হ্যালো
-কোথায় তুমি?
-কেনো?
-শাহবাগ?
-না
-সাইন্সল্যাব?
-না
-ফার্মগেট?
-না
নীলক্ষেত?
-না
-খামারবাড়ি?
-না
-কাজীপাড়া,শেওড়াপাড়া,দুই নাম্বার?
-না
-তাহলে?
-জানিনা
-তুমি বলো তুমি কোথায়?
-বলবো না
-আমি বাসে উঠছি.........এক্ষুণি দুই নাম্বার আসছি
- আমাকে পাবেন না
ফোন কেটে দেয় অর্না। কথার আগেও এক বিশাল গল্প পরেও  এক বিস্তর গল্প।

২।
.........
আব্দুল করিম এই শহরের স্বনামধন্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যপদস্থ একজন কর্মকর্তা,কিন্তু আয়ের পাল্লা খুব হালকা।বাস্তবতা।প্রতিদিনকার মতো আজ ও সকাল হয়েছে তার।আবিদা সুলতানা তার সহধর্মিনী আজ ও তার ব্যস্ত সময় কাটছে......
সকালের সময় টা সকলের জন্য ভালো , এসময় কারো রাগ হয়না।অর্ণা,অর্ণব তাদের দুই সন্তান।সকাল  তাদের ও হয়েছে। সকালে অবশ্য কেউ ই জানতে পারেনা এই সকাল তার জন্যে কী নিয়ে আসবে,এই দুজন ও ঠাওর করতে পারেনি।

ডাইনিং হলে আব্দুল করিম ও তার স্ত্রী রান্না ঘরে।সামান্য কথা কাটাকাটি, কথা কাটাকাটি থেকে বাক বিতণ্ডা। এরপর সর্বোচ্চ পর্যায়! সেই ভয়াবহ পর্যায়।প্রায় ২০ বছরের সংসারকেও মুহূর্তে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে সক্ষম।কথা গুলো শুনতে পাওয়া যায়না,যেন ‘ডিভোর্স চাই’ এই কথা গুলো আব্দুল করিম অতি সহজে আলু ভাজি দিয়ে রুটির সাথে গলাধঃকরণ করে পাকস্থলীতে চালান করে দিচ্ছেন!

সব সময়কার মতো অসহায় চরিত্রে থাকবে তাদের দুই সন্তান।একজন গেম খেলা ছেড়ে গুটিশুটি মেরে বসে থাকবে অন্য জন বরাবরের ন্যায় বিরক্ত।মহা বিরক্ত।

৩।
.........
বেলা বাড়তে থাকে সেই সাথে বিরক্তি কুণ্ডলী পাকাতে থাকে,কুন্ডলী এক সময় রাগে রূপান্তরিত হয় ।দমে যায়না,ফুসতে থাকে,দুপুর সময় টাই এমন।
সূর্য তখন প্রায় মাথার উপর তাপ দিতে ব্যস্ত।

অর্ণা চুপচাপ হাটতে থাকে ডাইনিং হলের ফাকা স্পেসে।আলুথালু থালাবাসন জানান দেয় তাদের হর্তাকর্তার তাদের প্রতি মায়া ফুরিয়ে এসেছে।খালি পায়ে জুতোর র‍্যাকের সামনে থেকে এগিয়ে যায়,বসার ঘরের দিকে পা বাড়াতে পায়ের নিচে বালুর কণা ঠেকে,সব সময়ের না দেখা ভাবটা আজ নাড়া দেয়! ঘর ঝাড়ু দেয়া হয়নি! পর্দার পাশে মাকড়শার ঝুল কিছু আলস্যের থেকে উদাসীনতা প্রকাশ করে বেশী।সেই উদাসীনতার আলাদা সংজ্ঞা আছে।  ভয়াবহ।
-মা তুমি আসলে কী চাও?
-মুক্তি
-কীসের থেকে?
-তোদের থেকে
-আমাদের ছাড়া তুমি সুখে থাকবে?
-হ্যাঁ
-তাহলে আরো কদিন আগে এই মুক্তি চাওনি কেনো?যখন আমি পৃথিবীতে আসিনি?যখন ছিলাম না তোমাদের মেয়ে,যখন এই পৃথিবী আমার ছিলো না ?
-এখান থেকে যা
-আমার উত্তর চাই
-দেখ তোর মতো বেয়াদব মেয়ে আমার কোনো কাজে আসবে না।তোকে দিয়ে আমার স্বপ্ন পূরণ হবেনা।তোর বাপ।এই লোকটা আমাকে মানুষ মনে করেনা। ভাবে তার টাকায় বসে বসে খাই আর উড়াই।টাকাই জীবনের সব না ।আমার চাওয়া ফুরিয়ে এসেছে.........

অর্ণা তার স্বভাবগত অভ্যাসে গ্লাসটা ফেলতে গিয়েও ফেলেনা।কারো সামনে কাঁদার অভ্যাস নেই তার।রুমে এসে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে একবার ভাবে ,জীবনটা কতোটা আলগা! কতো মানুষ বিনা দ্বিধায় এই ফ্যানের সাহায্যেই মুক্তি পেয়েছে! মুক্তি তো অনেক সোজা!.........

৪।
......
-কোথায় তুমি?
-জানিনা
-অর্ণা শোনো
-হু
-তোমার বাসায় যাওয়া উচিৎ
-দুঃখিত
-তোমাকে একটা জিনিস বলতে চাই
-জ্বী?
-সেটার জন্য একটা মিনিট সময় আমাকে দাও,দয়া করে বলো কোথায় আছো,সেখানে এসে বলে চলে যাবো
-এখনই বলেন
-তোমার পিঠে এখনো সেই কাজী নজরুল?
-হ্যাঁ
-আমি পপুলারের সামনে
-ভালো
-তুমি দুই নাম্বারে না?
-জানিনা
-বাসে ওঠার পর আমার একটা কথা মনে হয়েছে
-হু
-আমি তোমাকে ভালোবাসি
-বাহ! চমৎকার! কেনো?
-মেঘের কোনো দায় নেই বাগানের টুনটুনির কাছে।
ফোনটা কেটে যা্য। এইসব আদিখ্যেতা এ জীবনে অনেক বার দেখেছে। ইচ্ছে করছে বাসের নিচে মাথাটা রেখে মাথাটা পিষ্ট করে ফেলতে ।পরপর আসা বাস গুলোর মানুষ গুলোকে দেখে হিংসে হয় তার ! ওরা বড্ড সুখী। ওরা আসে খায়,ঘুমায়,পড়ে ......ওদের এভাবেই চলে।

৫।
.........
বিকেল থেকে একটা নাম্বারে প্রায় ২০০ বার চেষ্টা করেছে অর্ণা।নাম্বারটা বন্ধ।মায়ের নাম্বার।অন্য সময়ে অর্ণাকে এই মা ই পায় না সে এখন বার বার স্ক্রিনে তাকিয়ে চোখ ঝাপসা করে চলছে.........একবার টেক্সট টা দেখে।“তোর মা নানু বাড়ি চলে গিয়েছে আমার আসতে দেরী হবে অর্ণব ৬ টার আগে আসবে না তুই ৭ টার পরে বাসায় আসিস” বাবার টেক্সট! রাগে মাথায় আগুন জ্বলে গিয়েছিলো! সেই রাগ টা ধীরে ধীরে পানি হয়েছে,সে ভাবতে থাকে মা টা না থাকলে কে তাকে ৩ বেলা খেতে বলবে,কে বলবে “পড়তে বস যা”,কে বলবে “মোবাইলের ভেতর ঢুইকা যা”
কে বলবে “বাথরুমে কী ঘুমায় গেলি? বালিশ দিবো?”
রাত কিংবা বিকেলে পড়তে যাবার আগে কে টেনে হিঁচড়ে তুলবে...
বাহিরে থাকলে কে সন্দেহ দেখিয়ে বলবে “কী এখনো ঐ টার সাথে প্রেম করস”!
কে অনেক গুলো ভাত দিয়ে রাত দিন বিরক্ত করে রাখবে!
কে রাতদিন কানের কাছে বলতে বলতে কান ঝালাপালা করবে... “নামাজ পড় ,নামাজ পড় নাস্তেক গিরি বাদ দে” .....কে তার আজগুবি লেখা গুলো পড়ে প্রশংসা করবে............!
অর্ণা ভাবতে পারেনা,সব কিছু ভেবে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।রাস্তায় তখন কেউ নেই ।প্রায় ফাকা রাস্তায় তার হাহাকার কারো কানে পৌছায় না। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট গুলোর বুঝি দুঃখ হচ্ছে।প্রায় অর্ধমৃত আম গাছ টা যেন তার দুঃখে মাথা নত হয়ে আছে।ফুলহীন কৃষ্ণচূড়াটা তাকে নীরব সান্ত্বনা দিচ্ছে।মিথ্যে সান্ত্বনা। বেওয়ারিশ পাথরকুচি পাতাগুলো একটা নাম না জানা গাছ বেয়ে অনেক উপরে উঠে এসেছে।বেওয়ারিশ শব্দটাকে আজ তার খুব আপন মনে হচ্ছে।

কারণ ছাড়াই!

কান্না থামায়।চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। স্বপ্ন গুলোকে দলা পাকিয়ে ফেলে দেয় রাস্তার পাশের নর্দমায়।এক বান্ধুবীর বাসায় আসে। রাত তখন ঠিক ১১ টা ।বাসার মানুষের বিরক্ত মুখ গুলো নতুন কিছু সংজ্ঞা দাড় করায়।ফ্রীজের অসংখ্য নান্দনিক খাবার সাধা হয়,অর্ণা না করে ,এক গ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

নিজের ছন্নছাড়া বিছানারটার কথা মনে পড়ে যায়,মনে পড়ে বিছানাটার সাথে ঝুলানো মায়ের পুরনো টাওয়েলটার কথা ,মনে পড়ে রাত বিরাতে একা ঠাণ্ডা ভাত খাবার কথা।মনে পড়ে প্রতিবার ঝগড়ার পরে মায়ের ক্রন্দনরত দৃশ্য।গুবলেটে সব কিছু ছেড়ে এই রাত্রে সে ছাদে যায়,পরের বাসার ছাদের গাছ গুলো ও এখন আপন।ছাদের মেঝেতে শুয়ে তারার সাথে কথা হয় ,চাঁদের সাথে কথা হয়,ঘুম আসেনা।

ঘুম ও তখন স্বার্থপর।
এই পৃথিবীর সব থেকে অসহায় মানুষ গুলো হয়তো ভাঙা পরিবারের সন্তান গুলো।তাদের “আশা” কিংবা ‘স্বপ্ন” বলে কিছু থাকেনা।

তারা কালের বিবর্তনে হয় যাযাবর ,নয় উম্মাদ।
জীবন নিত্যই তাদের কঠোর হতে শেখায়।আবেগ গুলো তখন গলার কাছে।গিলে ফলে আবেগ গুলো ......আটকে ফেলাই তখন অভ্যাস।

মানুষ গুলো তখন মাথার উপর ছাদহীন রোবট,পায়ের নিচে মাটিহীন অসার মানুষ ,অসহায় সত্তা।

Comments