একটি অন্তিম লেখনী......

টেবিল থেকে হঠাৎ করে গ্লাসটা ফেলে দিলো তন্দ্রা।ভাঙ্গা অংশ তার হাতের চামড়া ভেদ করে আঘাত বসিয়ে যায়।সযত্নে সে দিনলিপির পাতায়, লেখায় স্মৃতিঘর কে সাজাতে দেখে,কত সুখ স্মৃতি এতে সে বন্দী করেছিলো, সেগুলো দিনলিপিতে দিব্যি বন্দী!বাস্তবে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছে।দু,চার পাতা উল্টে
সে হতবাক হয়ে যায়,চোখের কোণায় জমা পানি গুলো কষ্ট গুলোকে আর ধরে রাখতে পারেনা,ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়তে থাকে অজানার উদ্দেশ্যে

সে নিজেকে আয়নায় দেখে,তার ঘৃণা হয়,হিংসা হয়,তন্দ্রা! এ কোন তন্দ্রা!কার চোখের নিচে এমন বিস্তৃত কালিমা?কার শুষ্ক ঠোঁটে এমন বিদীর্ণ জীর্ণতা? কার চুলে রাজ্যের অন্ধকারের ঘনঘটা? কার শীর্ণ শরীরে নিপীড়নের বন্দোবস্ত? একে!কে সে!তার সেই মায়াবী চোখ জোড়া যেন দুঃখের প্রান্তসীমা হীন গর্ত।খুব ধীরে সে আয়নায় পর্দা ফেলে দেয়।সে লিখতে বসে,হয়তো তার শেষ লেখা,একেবারেই অন্তিম লেখনী।

হ্যা।এতদিনে আমি হয়তো অচ্ছুত হয়ে গিয়েছি,তোমাদের সভ্য জগতে আমার স্থান দেয়ার নূণ্যতম কসরত তোমরা বাকী
রাখোনি।কিন্তু আমি নিকৃষ্ট, আমি অচ্ছুত, আমি পতিতা।তোমরা আমায় এভাবেই জানো।একদিন আমার রূপ ছিলো,যৌবন ছিলো,আমার সৌন্দর্য ছিলো,তোমরা আমাতে মোহাবিষ্ট ছিলে।তোমরা মৌমাছি ছিলে,আমি ছিলাম রঙিন ফুলে জমানো একদলা মধু।তোমরা অবশ্য আমায় মানুষ নয়, মধু ভেবেছিলে।আমায় জীবন্ত নয় জীবাশ্ম ভেবেছিলে।

সেইদিনের কথা অবশ্য ভোলার মত ছিলোনা,সে স্মৃতি আমার দেহে না থাক, তোমাদের চোখে না থাক,আমার মস্তিষ্কে তা আছে।তোমরা কি কর্ণপাত করেছিলে?তোমরা জানতে চেয়েছিলে আমি কী চেয়েছি?না!তোমরা চাওনি।আমার অন্ধকারাবৃতা জীবনে আলো প্রবেশ করতে দাওনি।আমার এই জগৎ আমাকে আগলে রেখেছে,কিন্তু মনে হয়েছে এর থেকে মৃত্যু শ্রেয়। তোমাদের নোংরা কালো হাতের স্পর্শ আমাকে আর বিব্রত করেনি।তোমাদের শক্ত সমর্থ সুঠাম দেহ অবয়ব। তোমাদের দানবীয়, পৈশাচিক আনন্দের নিচে আমি নিজেকে সপে দিয়েছি।তোমরা মত্ত হয়েছো উল্লাসে,আমি কড়া নাড়তে শুনেছি মৃত্যুকে আমার দুয়ারে।তোমাদের সুতীব্র ভালবাসা!তোমাদের বেষ্টনী, তোমাদের বন্ধন।থুহ!

তোমরা হয়তো জানতে না,আকাশের পাখি কখনো খাঁচায় বন্দী থাকেনা।সে উড়ে যায়,মুক্তি না পেলে মরে যায়, তবু তোমাদের বন্ধনে নিজেকে বন্দী করেনা।

-তন্দ্রা।

উৎসর্গিত, সেই সকল ধর্ষিতা নারীকে যারা অসহায় ছিলো,যারা এখনো আছে।এভাবে কতো তন্দ্রা প্রতিদিন হারিয়ে যায়!কে হিসেব রাখে? তোমরা বরং আওড়াও মেয়ে জাতি আমাদের ভোগ্যবস্তু, আমাদের তৃপ্তিকারক যন্ত্র।আর আওড়ে যাও,"পর্দাবিহীন চলা ফেরা বিপদজনক, অতএব পর্দা করো"।

৭ বছরের মেয়ে। যৌনাবেদনময়ী? আকাঙ্ক্ষা জাগায়? ২/৩/৪/৫ বছর বয়সীরা? সকল কিছুর সমাধান পর্দা হলে এরা ধর্ষিতা হয় কেনো?

পরিবর্তন করা যায়না মূল্যবোধ?
দৃষ্টিভঙ্গি?

হুমায়ুন আহমেদ অবশ্য ঠিকই বলেছেন,
"জন্মের পর থেকে একটি গোষ্ঠীকে বলা হয়,"সাবধানে চলো,তা না হলে তুমি ধর্ষিত হবে! কিন্তু অপর গোষ্ঠীকে কখনই বলা হয়না- "ধর্ষণ পশুসমাজের কাজ,এই কাজ করলে তুমি মানব সমাজ থেকে বিতাড়িত হবে।"

Comments