লায়লাতুল কদর এর মাহাত্ম্য ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য

লায়লাতুল কদর :
আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কোরআন এর সূরা আল কদরে লায়লাতুল কদর সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি কোরআন কে লায়লাতুল কদর তথা মহিমান্বিত রাতে অবতীর্ণ করিয়াছেন। এই লায়লাতুল কদরকে আল লায়লাতুল মুবারাকা তথা বরকতময় রজনীও বলা হয়। ইহা রমযান মাসের শ্রেষ্ঠ একটি রাত যা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।



মহানবী (সা) বলিতেন :
লোক সকল তোমাদের কাছে রমযান মাস আগমন করিয়াছে। ইহ বরকতময় মাস। এই মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দ্বার বন্ধ করে রাখা হয় ও শয়তানদের কে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়। এই মাসে এমন একটি রাত আছে যাহা হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যে ব্যক্তি এই রাতের কল্যাণ হইতে বঞ্চিত হইবে, সে আসলেই কপাল পোড়া।
তিনি আরো বলেছেন,
যে ব্যক্তি শবে কদরে ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় জাগ্রত থাকিয়া ইবাদত করিবে তাহার আগের সকল সগীরা গুনাহ মাফ করিয়া দেয়া হবে।

শবে কদরের রাত এমনি এক গুরুত্বপূর্ণ রাত যে রাতে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং মানুষের হায়াত ও রিযিক নির্ধারণ করা হয়। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
এই রাত্রিতে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।


শবে কদর ঠিক কবে তা সম্পর্কে বুঝার জন্য নবীজি (সা) বলেন,
কদরের রাত হল রমযানের শেষ দিনে। ইহা যেকোন বেজোড় রাত্রিতে হয়ে থাকে। একুশ, তেইশ, পঁচিশ, সাঁইত্রিশ, উনত্রিশ কিংবা শেষ রাত্রিতে।
মহানবী (সা) আরো বলেন :
লায়লাতুল কদরের লক্ষণ হল এই রাতটি অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জ্যোতির্ময় ও শান্ত থাকে। না গরম না ঠাণ্ডা থাকে। এই রাতে ফযর পর‍্যন্ত কোন নক্ষত্র নিক্ষিপ্ত হয় না। আরেকটি লক্ষণ হল, সে রাতের সকাল বেলা যে সূর‍্য উদির হয় তাঁহাতে কিরণ থাকে না। ঠিক পূরনিমার চাঁদের ন্যায় শান'ত শীতল থাকে। সেদিন সূর‍্যের সাথে শয়তান আত্মপ্রকাশ করে না।

কা'ব (রা) হতে বর্ণিত হয় যে,
কা'ব (রা) বলেন, সিদরাতুলমুনতাহা জান্নাত সংলগ্ন সপ্তম আকাশের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। উহার চূড়া জান্নাতে এবং ডালপালা মহান আল্লাহর কুরসীর নিচ পর‍্যন্ত বিস্তৃত। উহা এত সংখ্যক ফেরেশতার অবস্থান যাহার সংখ্যা আল্লাহ্‌ ছাড়া কারো জানা নেই। তাহারা ডালে ডালে আল্লাহ্‌র ইবাদত করে। চুল পরিমাণ এতটুকু জায়গাও খালি নেই, যেখানে কোন না কোন ফেরেশতা অবস্থান করে না। উহার মাঝখানে হযরত জীবরাইল (আ) এর আসন। কদরের রাতে সেখানকার সকল ফেরেশতাদের সাথে নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করার জন্য আল্লাহ্‌ তা'য়ালা জীবরাইল (আ) কে নির্দেশ দেন।এদের প্রত্যেকের হৃদয়েই আল্লাহ ঈমানদারদের প্রতি দয়া ও করুণা দান করিয়াছেন। ফলে শবেকদর এর সূর‍্যাস্তের সাথে সাথে তাঁহারা জীবরাইল (আ) এর সাথে অবতরণ করিয়া পৃথিবীর প্রতিটি ভূ-খন্ডে ছড়াইয়া পড়ে এবং দণ্ডায়মান কিংবা সিজদারত অবস্থায় ঈমানদার সকল নর-নারীর জন্য দোয়া করে। তবে গীরজা, মন্দির, অগ্নিপূজা ঘর, আবর্জনার ফেলার স্থান, যে ঘরে নেশাদার দ্রব্য থাকে, যে ঘরে মূর্তি স্থাপন করা থাকে ইত্যাদি অপবিত্র স্থানে তাঁহারা গমন করেন না। রাতভর তাঁহারা ঈমানদারদের জন্য দোয়া করিতে থাকে। হযরত জীবরাইল (আ) প্রত্যেক ঈমানদারের সহিত মুসাফাহা করেন। এর লক্ষণ হল, সেই রাতে খোদার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হওয়া হৃদয় বিগলিত হওয়া ও চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হওয়া। হযরত জীবরাইল (আ) এর মুসাফাহার ফলেই এরকম হয়ে থাকে।
কা'ব (রা) বলেন, এই রাতে কেহ তিনবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করিলে একবারের বিনিময়ে আল্লাহ্‌ তাকে মাফ করে দেন, একবারের বিনিময়ে দোজখ হতে মুক্তি দান করেন এবং একবারের বিনিময়ে জান্নাত দান করেন।
কা'ব (রা) জিজ্ঞেস করা হয়, সঠিক বিশ্বাসে ইহা পাঠ করিবে, তাহার জন্য এই পুরষ্কার? উত্তরে কা'ব (রা) বলেন, সঠিক বিশ্বাসী ছাড়া কি কেহ লায়লাতুল কদরের লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেন? আমি সেই আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি যে, কদরের রাত কাফির মুসরিক ও মুনাফিকিদের জন্য বড় ভারী হয়ে থাকে। যেন তাদের মাথার উপর পাহাড় চড়িয়া বসে। ঠিক সুবহে সাদিকের আগ পর‍্যন্ত ফেরেশতারা এভাবে দায়িত্ব পালন করে থাকে।

এইবার ফেরার পালা। সর্বপ্রথম হযরত জিবরাইল (আ) উপরে আরোহণ করে উ্ধ্ব দিগন্তে নিজের পালক ছড়িয়ে দেন তাহার সবুজ বর্ণের দুইটি পালক এমন আছে যাহা এই দিন ব্যতিত অন্য কখনো বিস্তার করেন না। এতে সূর‍্য নিস্প্রভ হয়ে পড়ে। অতঃপর একে একে অন্যান্য ফেরেশতারা উপরে চলে যান। হযরত জীবরাইল (আ) এর দুই পালকের নূর এবং অন্যান্য ফেরেশতাদের নূর এক হয়ে সেইদিন সূর‍্যের আলোকে ম্লান করে দেয়। হযরত জীবরাইল (আ) ও অন্যান্য ফেরেশতারা সেদিন পৃথিবী ও প্রথম আকাশের মাঝে অবস্থান করে ঈমানদার নর-নারী, ঈমানের সহিত সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা পালনকারীদের জন্য ইসতিগফার ও রহমতের দুয়া করিতে থাকে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে তাঁহারা প্রথম আকাশে প্রবেশ করে বৃত্তাকারে বসে পড়ে। তখন প্রথম আকাশের ফেরেশতারা এসে তাঁহাদের সাথে মিলিত হয়ে দুনিয়ার এক এক করে সকল নর-নারীর সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে আর ইহারা উত্তর দিতে থাকে। জিজ্ঞাসা করা হয় যে অমুক ব্যক্তি কি কাজ করেছে অমুক ব্যক্তিকে তোমরা কি অবস্থায় পেয়েছো? উত্তরে তাঁহারা বলেন, গত বছর তো অমুককে ইবাদাতে লিপ্ত পেয়েছি কিন্তু এইবার পেয়েছি বিদ'আতে লিপ্ত অবস্থায় আর অমুক ব্যক্তিকে বিগত বছর বিদ'আতে লিপ্ত অবস্থায় পেয়েছি আর এইবার রুকু সিজদারত অবস্থায় পেয়েছি।
একদিন একরাত তাঁহারা প্রথম আকাশে থাকিয়া দ্বিতীয় আসমানে চলে যান। এইভাবে প্রত্যেক আকাশে একদিন একরাত অবস্থান করিতে করিতে একসময় নিজেদের আসল আবাসস্থল সিদরাতুলমুনতাহায় পৌঁছে যায়। সিদরাতুলমুনতাহা তাঁহাদের বলে, হে আমার অধিবাসীগ্ণ! আমারো তোমাদের উপর অধিকার রয়েছে, আমিও তাদের ভালোবাসি যারা আল্লাহ্‌ কে ভালোবাসে। দুনিয়ার লোকের ভালো-মন্দ হিসেব সংবাদ আমাকেও শুনাও। কা'ব (রা) বলেন, তখন ফেরেশতারা এক এক করে নিজের ও বাপের নাম ধরিয়া দুনিয়ার সকল নারী ও পুরুষের অবস্থা তুলে ধরবে। অতঃপর জান্নাত সিদরাতুলমুনতাহা কে বলে, তোমার অধিবাসীরা তোমাকে কি সংবাদ দিয়েছে, আমাকেও শুনাও একটু। সিদরাতুলমুনতাহা জান্নাত কে সকল বৃত্তান্ত শুনায়। শুনে জান্নাত বলে অমুক পুরুষের উপর আল্লাহর রহম হউক, অমুক নারীর উপর আল্লাহ্‌র রহম হউক। হে আল্লাহ! অতি সত্ত্বর তাহাদের কে আমার কোলে পৌছায়ে দাও। অতঃপর জিবরাইল (আ) সকলের আগে তার আসন গ্রহণ করবেন। এবং আল্লাহ্‌র কাছে ঈমানদার নর-নারীর জন্য ক্ষমা এবং রহমত কামনা করবেন এবং আল্লাহু তাদের ক্ষমা করে দিবেন। সাথে সাথে আরশবহনকারী ফেরেশতারাও আল্লাহর কাছে আর্জি করতে থাকবেন এবং আল্লাহু তাদের ক্ষমা করে দিবেন।

অতঃপর জিবরাইল (আ) বলবেন, হে আল্লাহ্‌! অমুক ব্যক্তি কে গত বছর ইবাদতে লিপ্ত দেখেছিলাম, কিন্তু এই বছর তাকে অপকর্মে লিপ্ত পেয়েছি। সে তোমার হুকুম আহকাম ছাড়িয়া দিয়াছে। আল্লাহতালা বলবেন, শুন জিবরাইল, যদি সে তাওবা করে, মৃত্যুর তিন ঘন্টা আগেও যদি সে তাওবা করে তো আমি তাকে ক্ষমা করে দিবো। শুনিয়া জিবরাইল (আ) বলেন, ইলাহী! সকল প্রশংসার মালিক তুমি। তুমি তোমার সকল সৃষ্টি অপেক্ষা দয়ালু। তোমার সৃষ্টির প্রতি সৃষ্টির যতটুকু দয়া তাহাদের উপর তোমার দয়া অনেক বেশি। তখন আরশ ও তাহার চতুরপাশ এবং আকাসমন্ডলী ও উহাতে যাহা আছে সবই দুলিয়া উঠে। সকলেই বলিয়া উঠে, সমস্ত প্রশংসা দয়াময় আল্লাহর প্রাপ্য, সকল প্রশংসা দয়াময় আল্লাহর প্রাপ্য।
কা'ব (রা) আরো উল্লেখ করেন যে, যে রমযান মাসে রোযা রাখে এবং রমযানের পরও গুনাহ হতে বিরত থাকার সংকল্প রাখে, সে সওয়াল-জওয়াব ও হিসাব-কিতাব ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করিবে।


আল-কোরআন ও সহীহ হাদিস হতে সংকলিত ও সংরক্ষিত
লেখা- মুহাম্মদ কায়েস আব্দুল্লাহ

Comments