যা চেয়েছি, যা পাবো না - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু তো চাইনি আমি ।
-চাওনি তা ঠিক । তবু কেন এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ?
-জানি না । ওদিকে দ্যাখো রোদ্দুরে রুপোর মতো জল, তোমার চোখের মতো, দূরবর্তী নৌকো, চর্তুদিকে তোমাকেই দেখা
-সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ?
-আমি দেবী নই ।
-তুমি তো জানো না তুমি কে !
-কে আমি !
-তুমি সরস্বতী, শব্দটির মূল অর্থে যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া, মাঝে মাঝে নারী নামে ডাকি
-হাসি পায় শুনে । যখন যা মনে আসে, তাই বলো, ঠিক নয় ?
-অনেকটা ঠিক । যখন যা মনে আসে - কেন মনে আসে ?
-কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না
-আশীর্বাদ !
-আশীর্বাদ ? আমার, না সত্যি যিনি দেবী
-তুমিই
তো সেই ! টেবিলের ঐ পাশে ফিকে লাল শাড়ি আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি,উঠে
এসো, আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত, আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল
করে তোলো, খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল, নোখ দিয়ে চিরে দাও
-যথেষ্ট পাগল আছো ! আরও হতে চাও বুঝি ?
-তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন শান্তশিষ্ট
-না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ?
-ভালো
মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবনকাটাতুম, তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের,
বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর; ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন
-যে জীবন মানুষের ?
-আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে, তোমাকে দেখার আগে
-তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে, অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো,পলক পড়ে না, কী দেখো অমন করে ?
-তোমার ভিতরে তুমি, শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে, তুমি, তার আড়ালে যে তুমি
-সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা
-শোন্ খুকী
-এই মাত্র দেবী বললে-
-একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী - তুই সেই নীরা, তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
-সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি
-তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও
-কী আছে আমার ? জানি না তো
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই
-সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা, তখন তো বলোনি কিছু ?
আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা, আমারই নিজস্ব–শৈশবের হাওয়া শুধু জানে
-দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ? আমি ধনী হবো
-আমার তো দুঃখ নেই–দুঃখের চেয়েও কোনো সুমহান আবিষ্টতা আমাকে রয়েছে ঘিরে, তার কোনো ভাগ হয় না, আমার কী আছে আর, কী দেবো তোমাকে?
-তুমি
আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই ! তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে
বসি, মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ… তবু সেখানেও শেষ নেই, কবি নয়, মুহূর্তে
পুরুষ হয়ে উঠি, অস্থির দু’হাত, দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায়, সিংহিনীর মতো ঐ
যে তোমার কোমর, অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে, যেন কোনো গুপ্ত
সংবাদের জন্য ছটফটানি
-পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো, তোমায় কী দিতে পারি ?
-কিছু নয় !
-অভিমান ?
-নাম দাও অভিমান !
-এটা কিন্তু বেশ ! যদি অসুখের নাম দিই নির্বাসন, না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব, দূরত্বের নাম দিই অভিমান ?
-কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ?
-কী করে ভাবলে যে ভুলবো ?
-তুমি
এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি, কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল, পাড়ের
নক্সায় ঢাকা পা, ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি-এই দৃশ্যে অমরত্ব; তুমি তো জানো
না, নীরা, আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে ।
-সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ?
-মৃত্যু ?
-ছিঃ , বলতে নেই
-তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল
-পাওনি কি ?
-বুঝতে পারি না ঠিক । বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায়, শরীরও সে চায়, তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ?
-ফের পাগলামি ?
-দেখা দাও ।
-আমিও তোমায় দেখতে চাই ।
-না !
-কেন ?
-বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর এ কথা, আমি ভয় পাবো। এ শুধুই এক দিকের,আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না
-তুমি এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে–
-তুমি কবি ?
-তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু নয় । আমার দু’চোখে যদি ধুলো পড়ে, আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ?
_________________________________________________ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
Comments
Post a Comment